অরিদমন

অরিজিত। না নামটা বললে প্রথমে এখন যার কথা মাথায় আসে, আমাদের গল্পের নায়ক সেই গানের রাজা অরিজিত সিংহ নয়। এই অরিজিত নিতান্তই সাধারণ এক গ্রামের ছেলে। গ্রাম বলছি বটে, কিন্তু তাকে মফস্বল বলাই বোধহয় ভাল হবে। তার রাস্তায় বোধকরি পাত পেড়ে খাওয়া যায়…এমন তকতকে। বলা যেতে পারে, তার রাস্তার
“দুই পাশে ধান
প্রকৃতির দান
দুলে ওঠে সমীরণে।
বলে দেবে কবি
আঁকা রবে ছবি
চিরতরে মোর মনে। ”
না, ‘রবার্টসনের রুবি’তে জটায়ু যে কোপাঈ এর ধারে দাঁড়িয়ে বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতাখানি আবৃত্তি করেছিলেন, আমাদের গন্তব্যস্থল সেখানে নয়। এই গ্রামের নামখানা ভারি সুন্দর–পিয়ালডুবি। আমাদের বলতে আমি আর অভীক। যদিও কলেজে আসার পরে অভীকের সাথে আলাপ হয়েছে আমার, জানি না কেন ইতিমধ্যেই দুজনে যাকে বলে হরিহর আত্মা হয়ে গেছি একেবারে। আমায় ছাড়া ও এক পা এগোয় না, না ওকে ছাড়া আমি।
সে যাক। যা বলছিলাম, অভীক আর আমার মধ্যে একটা জিনিস খুব কমন, সেটা হল ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ গোছের মনোভাব। হুটহাট প্ল্যান তৈরি হয় আমাদের, যদিও অধিকাংশ সময়েই তা বাতিল করতে হয়। এবারও ঠিক তেমন করেই একদিনের নোটিসে বেরিয়ে পড়েছি একজোট হয়ে। মা-বাবা বলে বটে “কলেজে উঠেই ছেলের পাখা গজিয়েছে”- থোড়াই কেয়ার। তবে ঝাঁ-চকচকে শপিং মল বা পার্কের থেকে আমাদের দুজনেরই পছন্দ এমনি গ্রাম টামের দিকে যাওয়া।

অপ্রত্যাশিতভাবে পুরো পাঁচ দিনের ছুটি পেয়ে গেলাম কলেজে। ব্যাস আর যায় কোথা। মোটামুটি সব কটা গ্রুপেই ঠিক হয়ে গেল দুদিন যে যার সঙ্গী, থুড়ি সঙ্গিনীদের নিয়ে ঘুরবে চুটিয়ে, আর তারপর হোস্টেলের রুম তো আছেই ল্যাদ খাওয়ার জন্যে। আবার একটা দল ঠিক করে বসল এই ফাঁকে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। ব্যাপারটা হচ্ছে কোন দলেই আমার নাম লেখানো হয়ে উঠল না। প্রেমিকা আমার জোটেনি, অগত্যা প্রথম দলে ভিড়তে পারলাম না। দ্বিতীয়ত, দু’সপ্তাহ আগে বাড়ি থেকে এসে যদি এত জলদি আবার বাড়ি ফিরে যাই, বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে ছাড়বে আমায়। অগত্যা বসে বসে হাঁ করে যখন ভাবছি কি করা যায়, এমন সময় হাতা গোটাতে গোটাতে অভীক এসে হাজির।
-কিরে কি ভাবছিস হাঁ করে?
-হুঁ? কই কিছু না তো?
-কোন দলে ঢুকলি? অবিশ্যি তুই ল্যাদখোর নোস আমি জানি,তবুও …বিরহে মানুষ সব করতে পারে।
-সবসময় খোঁচা না দিলে হয় না না?
-আরে বাবা চটছিস কেন? বললেই হয় জুটিয়ে দে একটা।
-একটা নয় একজন।
-ওই হল। তা যাক, কি করবি পাঁচদিন ধরে?
-তাই ভাবছিলাম। কি করা যায় বল না?
-ঘুরতে যাবি?
-কোথায়?
-যে কোন জায়গায় হোক। কবের থেকে তো হস্টেলে বন্দি হয়ে আছি।
-সে তো ঠিক আছে, কিন্তু যাবোটা কোথায়?
-আচ্ছা আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখছি। রাত্রে হস্টেলে বলে দেব নাহয়। যাই এখন।
-কোথায়?
-আরে খোঁজ কি তোর মুখের দিকে তাকিয়ে নেব নাকি!
-ও আচ্ছা আচ্ছা।
-চললুম ভাই। দেখিস বিরহে আবার কিছু …
-যা ভাগ এখান থেকে।
অভিটাকে বিদেয় করে হোস্টেলের দিকে পা বাড়ালাম। আর কিছু না হোক, বাড়িতে অন্তত একবার জানিয়ে রাখা দরকার। বলতে গেলে এই কলেজে আসাই আমার প্রথম বাড়ির বাইরে অভিভাবকহীন পা রাখা…অগত্যা প্রত্যেকটি পা গুনে গুনে ফেলতে হয়। অভিকে যতটুকু জানি নির্ঘাত এমন জায়গার খোঁজ নিয়ে আসবে মানচিত্রেও বোধহয় তার খোঁজ মিলবে না, সেখানে মোবাইলের টাওয়ার তো দূর অস্ত। আমার ঘরে ফোন করার পর একবার ওর মাকেও জানিয়ে দিলাম। যেরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন তাতে কিছুই বলা যায় না।
রাত আন্দাজ ন’টা নাগাদ চুটিয়ে আড্ডা হচ্ছে রুমে, এমন সময় অভি এসে হাজির। চোখেমুখে এমন উল্লাস যেন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। এসে আমায় আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল।
-কিরে কি ব্যাপার?
-যাওয়ার যায়গা পেয়ে গেছি বস।
-তো সেটা বলতে এই ঠান্ডার মধ্যে বাইরে টেনে আনতে হবে?
-আরে শোন। যেখানে যাব সেখানে দু-তিন জন মিলে গেলেই ভাল। বেশি লোক গেলে ফ্যাচাং হতে পারে। বুঝলি?
-যাবিটা কোথায় বলত? কি মতলব?
-আরে খারাপ মতলব কিছু না।
দিয়ে হুট করে গলা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল আমার সাথে, যেন ওর কথা কেউ শুনে ফেললে বিরাট কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
-এখান থেকে আন্দাজ তিন-চার ঘন্টার জার্নি( পাঠক ধরে নিন ওটা দেড় ঘন্টার বেশি হবে না…আমার বন্ধুবরটির একটু রং চড়ানোর অভ্যেস আছে) দূরে একটা গ্রাম টাইপ জায়গা আছে…
মোটামুটি ঝাড়া দশ-পনেরো মিনিট ধরে ও বকে যাওয়ার পর আমি যা বুঝলাম তার সারমর্ম হলো এই-
এখান থেকে খানিক দূরে একখানা গ্রাম আছে। ও নাকি ফেসবুকের কোন পেজে পড়েছে যে মাঝে মাঝে সেখানে রাতবিরেতে একদল তান্ত্রিককে দেখা যায়…হাতে আসল নরমুন্ড নিয়ে কালীসাধনা করতে যেতে। আর তাদের দেখতে যতজন গেছে কেউই আর প্রাণ বা মুন্ডু, কোনটাই নিয়ে ফিরে আসেনি।   সিনিয়ররাও পারতপক্ষে ওইদিকে পা বাড়ায় না(অবিশ্যি যাবেই বা কেন! তাদের অন্য কাজ আছে তো নাকি) …আর আমরা দুই জুনিয়র এই কাজ করেছি জানতে পারলে আর রক্ষে নেই। অতদূর যেতে হবে না কষ্ট করে…এই হোস্টেলেই মুন্ডুপাত অনিবার্য। এখন বাবুর মনে খেয়াল চেপেছে তিনি ওই রহস্য ভেদ করবেন যেমন করেই হোক।
আমি বাধা দিলাম না, জানতাম দিয়েও কোন লাভ হবে না। অভিটা চিরকালের একগুঁয়ে, যেটা বারণ করা হবে সেইটাই সবার আগে করবে। অবশ্য ওই প্রবৃত্তিটা যে আমারও নেই তা অস্বীকার করা অন্যায় হবে, তবে ওর হল গিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের যাকে বলে তাই। অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম যেতে…রহস্যভেদ হোক না হোক, অভিজ্ঞতা তো একটা হবে!
আধঘন্টা ধরে তর্কাতর্কির পরে ঠিক করা হল যে আমি কাল আগেভাগে বেরিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করব বাসস্ট্যান্ডে, অভি খানিক পরে বেরিয়ে এসে চলে আসবে সেখানে…তারপর সেখান থেকে যাত্রা শুরু।
বাস্তবে করলামও তাই। সকালবেলার জলখাবার খেয়ে নিয়ে আমি বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। করার কিছু নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানপাট রাস্তার গাড়ি ইত্যাদি দেখছি এমন সময় হাতে ইয়াব্বড় ঢাউস একখানা প্যাকেট আর একগাল হাসি নিয়ে অভি হাজির।
-কিরে এতবড় প্যাকেট কিসের?
-আরে রাস্তার খাবার।
-তুই যে বলেছিলি তিন ঘন্টার জার্নি, তবে?
-আরে তাই বলে কি খিদে পাবে না নাকি!
পোকার ফেস করা ছাড়া আর কিছু করার খুঁজে পেলাম না। আজব চিড়িয়া একখানা।

সে যাক। বর্তমানে ফিরে আসি। বাস আড়াই ঘন্টা লেটে চলছে…কোথায় নাকি অবরোধ হয়েছিল। খাবারের প্যাকেটটা এনেছিল বলে রক্ষে…নইলে সকালে এমন কিছু খাইনি যে দুপুর তিনটে অবধি পেট চুঁইচুঁই করবে না।
স্ট্যান্ডের নামটাও অদ্ভুত- মুন্ডাপাড়া। নামকরণ এই কাটমুন্ডু এপিসোডের জন্যে হয়েছে না উলটোটা বুঝতে পারলাম না। তবে একটা কথা স্বীকার না করে থাকতে পারলাম না দু’জনেই- জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর। যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা ছোট গ্রাম একটা। যতটুকু দেখা গেল বুঝলাম গ্রামের অধিকাংশই কাঁচাবাড়ি। শুধু যুগের সাথে তাল মেলাতেই বোধহয় স্ট্যান্ডের ধারে একটা ধাবা গোছের দোকান। এতক্ষণ মাথায় ঢোকেনি, এইবারে খেয়াল হল আমার।
-হ্যাঁরে চলে তো এলাম, থাকবি কোথায়?
-আরে ঠিক জায়গা হয়ে যাবে, আগে খিদেটা তো মেটাই।
হক কথা। যা খিদে লেগেছিল আর বলার নয়। অতএব পায়ে পায়ে দোকানটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি দোকান তো প্রায় পুরো ফাঁকাই, তার থেকেও আশ্চর্য দোকানের মালিকের কোন পাত্তা নেই। একটিমাত্র লোক রুটি খাচ্ছে বসে বসে। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুকি মারছি এমন সময় আচমকা  পিছন থেকে একটা হেঁহেঁ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। প্রথমবার দেখলে ভড়কে যেতে হয়। জ্যান্ত মানুষের চেহারা এমন শুকনো হতে পারে ভাবা যায় না।
-বাবুরা কুথা থিকে আসতিছ?
দেহাতি লোক। আমি আন্দাজ করলাম দোকানের মালিকই হবে হয়ত।
– বড্ড দূর থেকে। তা তুমি এই দোকানের মালিক না কি?
-আজ্ঞে হাঁ বাবু।
-কিছু খাবার হবে?
-হাঁ হাঁ হবেনি কেনে … এই বলে পিছু ঘুরে বোধহয় কোন কর্মচারীর উদ্দেশ্যে হাঁক পেড়ে বলল-
-এই অরু, বাবুদের জন্যে দু-পেলেট খাবার লাগা দিকি। বাবু, আপুনে বসুন, খাবার আসতিছে।
বসলাম ভিতরে গিয়ে। বসে বসে যখন ভাবছি এই ভরদুক্কুরে থাকার জায়গা পাব কোথায় এমন সময় অভি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে কিনা-
-বুড়োটা আর একটা হস্ব্র ই বসালে বেশ সাধুভাষায় কথা বলত না?
ভস্ম করা লুক নিয়ে তাকাতে গিয়ে দেখি প্যাঁচার মতন মুখ করে বসে আছে। গালাগাল দিয়ে ভুত ভাগাতে যাব এমন সময় ভিতর থেকে একজন খাবার নিয়ে এল। ধোঁয়াওঠা রাঙা চালের ভাত, আলুমাখা, কলাইয়ের ডাল আর গরমাগরম মুরগির মাংসের ঝোল। এমন সুখাদ্য পাওয়া যাবে এই পান্ডববর্জিত দেশে,তাও এমন সময়, কল্পনাতেও আসেনি। খাওয়াদাওয়ার পাট শেষ করে বিল মেটাতে যখন বেরিয়ে এলাম বেলা পড়তে বেশি দেরি নেই। অভি বিল মেটাচ্ছে এমন সময় আমি জানতে চাইলাম এখানে কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা। উত্তর এল,
-আজ্ঞে বাবু এখুন ঘর…
কখন যে কর্মচারীটা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পাইনি।
-আপনারা যদি চান তো আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। আমি আজ রাতটা থাকব না…এক জায়গায় যেতে হবে-
বলেই থেমে গেল। চোখেমুখে কিসের যেন ছায়া পড়ল ছেলেটার একমুহূর্তের জন্যে, যেন ভুলবশত বেফাঁস কোন কথা বলে ফেলেছে। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল
-আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে…
-না না আপত্তির কি আছে!
তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম আমি সামলাবার জন্যে। অভিটাকে কোন ভরসা নেই, হয়ত এমন কিছু বলে বসল পুরো গাঁসুদ্ধ তেড়ে এসে চড়াও হল আমাদের ওপর। কোন চেনাজানা কেউ নেই চারপাশে, বিদেশবিভুঁইয়ে বিপদ আপদ হলে বাঁচাবে কে! তার ওপর আমরা যে কাজে এসছি তা মোটেই নিরাপদ নয়।
-তাহলে আমি বরং বাইরেটায় দাঁড়াই, আপনারা বিল মিটিয়ে আসুন।
অভিকে ইশারা করে আমি ছেলেটার সাথে বেরিয়ে এলাম। কথায় কথায় জানলাম ওর নাম অরিজিত। আমিও আমাদের নামগুলো বলে দিলাম। কলেজে পড়ি জানালাম। কলেজের কথা উঠতেই দেখলাম মুখের ওপর যেন বিষণ্ণতার ছায়া পড়ল একটা। আন্দাজ করলাম হয়ত পারিবারিক চাপে পড়ে বেচারাকে কাজ নিতে হয়েছে, ওর বোধহয় পড়ার ইচ্ছে ছিল। যাই হোক, সম্মোধনটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসছে যখন অভি বেরিয়ে এল।
-চ’ যাওয়া যাক।
অরিজিতের পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে একবার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলাম। যা আন্দাজ করেছিলাম তাই, চার্জ আছে কিন্তু টাওয়ার বলে কিছু নেই। অগত্যা আবার হাঁটার দিকে মন দিলাম। ওদিকে আমার বন্ধুবরটি অরিজিতের সঙ্গে এমন আলাপ জমিয়ে ফেলেছে যেন দুজনে পূর্বজন্মের ভাই ছিল।
আমি পথের দুপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছিলাম। বেলাশেষের তান ধরেছে হাট থেকে ফেরা চাষীরা, গরু-বাছুরের খুরের ধুলো উড়ছে হাওয়াতে, আর ওদিকে অস্তগামী সূর্য ডুবছে একপুরু কুয়াশার আড়ালে। এককথায় বলতে গেলে, আমার মতন মানুষের জন্যে স্বর্গ।

মোটামুটি কুড়ি মিনিট একটানা হেঁটে গিয়ে অরিজিতের বাড়ি এল। নিকোনো উঠোন তকতক করছে, ঢোকবার গেটে মালতীলতার ঝাড়, মাটির দেওয়ালে আলপনা আঁকা, এক কোণে একটা খুঁটির সাথে ছাগল বাঁধা। আমাদের দেখে ম্যা ম্যা করে ডাকতে শুরু করল। অরিজিত আমাদের নিয়ে ঢুকল ওর ঘরে। পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। এককোণে দুটো চৌকির ওপর বিছানা পাতা,আমাদের সেখানে বসিয়ে বলল
-তোমরা বসে গল্প কর, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।
-কোথায় যাবে?
-তোমাদের জন্যে চাট্টি মুড়ি মেখে আনি, আর ছাগলটাকেও খাবার দিতে হবে।
-আচ্ছা আচ্ছা।

এবার আমি চেপে ধরলাম অভিকে।
-এতক্ষণ কি ভাঁটাচ্ছিলি রে ওর সাথে?
-আরে শোন। ছেলেটার মা-বাবাও ওই কাটামুন্ডুর শিকার। বেচারা কলকাতায় পড়তে গিয়েছিল, খবর পেয়ে যখন আসে ততক্ষণে পাড়ার লোকেই পুড়িয়ে দিয়েছে। অগত্যা নিজের পেট চালানোর জন্যে বেচারাকে কাজ নিতে হয়েছে এখানে।

যা আন্দাজ করেছিলাম তাই।
-ওর ধারণা এখানে কোন পাচারচক্র কাজ করে। হাইওয়ের ধারে গ্রাম, তার ওপর নিরিবিলি জায়গা। চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্য।
-কিন্তু মুন্ডুগুলো পাওয়া কোথায় যায়? সেটা জানতে চেয়েছিস?
-উফ না বকে শোন না। ওর আরও ধারণা যে দোকানটায় আমরা খেলাম, সেই মালিক বেটাই এদের চাঁই। ওর দোকানটা লোকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে মাত্র, আদতে ওইটিই হচ্ছে ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট। বুঝলি?
-হুম।
ভাবা শুরু করব এমন সময় অরিজিত এল একখানা বড় জামবাটি নিয়ে আর অন্য হাতে একটা হারিকেন নিয়ে। মুখে একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল-
-কিছু মনে কোর না, একটাই বড় বাটি ঘরে।
-আরে না সেটা কোন ব্যাপার না। এস শুরু করা যাক। খেতে খেতেই না হয় আলোচনা হবে কি করব রাতে।
-বেশ তাই হোক।
একমুঠো মুখে দিয়ে মনে হল অমৃত। উপকরণ বেশি কিছু না, শুকনো লঙ্কা আর আদা ভেজে, পেঁয়াজ চানাচুর টমেটো দিয়ে চরম রেসিপি। একবার রেলগাড়ির হকাররা জানতে পারলে হয়।
-তা অরিজিত, তোমার মনে এই স্মাগলিং এর ধারণাটা এল কোথাথেকে?
-ভাই আমি ওখানে কাজ করি ঠিক, তবে চোখকান খোলা রাখি। আর হাজার হলেও কলকাতার জলহাওয়া খেয়েছি, একেবারে মূর্খ নই। মাঝে মাঝে এক বাক্স করে মাল আসে, একদিন খুলে দেখে নিয়েছিলাম যা দেখার। তাছাড়া আমার আরও মনে হয়…
চোখ বুজে মুড়ির স্বাদ চাখতে চাখতে ওর কথা শুনছিলাম। আচমকা বিরতি পড়ায় তাকিয়ে দেখি রগ দুটো ফুলে উঠেছে ওর। আমি অভির দিকে তাকাতে অভি প্রশ্ন করল ওকে-
-কি মনে হয় তোমার?
-আমার মনে হয় ওই আমার মা-বাবাকে মেরেছে। রাতে মা বাবা একটু হাঁটতে বেরোতেন। হয়তো ওদের ব্যবসার কিছু দেখে নিয়েছিলেন, তাই…আমি ওঁদের মরা মুখটা পর্যন্ত দেখতে পাইনি…
বলতে বলতে গলার আওয়াজটা বুঁজে এল ওর। আমরা নিশ্চুপ হয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। খানিক পরে অভীকই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বলল
-তাহলে আজ রাতের প্ল্যান কি?
-আমি আজ ওর দোকানের ওপর নজর রাখব। আমি জায়গা দেখিয়ে দেব, তোমরা অন্যদিকে শ্মশানের পিছনে লুকিয়ে থেকে নজর রাখবে। ওখানেই আমার মনে হয় এদের মাল আসে। তান্ত্রিকের কমন্ডলুর ভেতর গঙ্গাজল আছে না অন্যকিছু, কে দেখবে?
ঠিক কথা। তাছাড়া কার ঘাড়ে কটা মাথা যে জেনেশুনে এই বিপদের মুখে ফেলবে নিজেকে? তবে অন্য একটা ধন্দ চাড়া দিল আমার মনে।
-কিন্তু একযাত্রায় পৃথক ফল ভাল হবে কি? সবাই একসাথে থাকলেই তো ভালো হত।
-না।
দৃঢ়স্বরে বলে চলল অরিজিত,
-আমাদের তিনজনেরই কিছু হয়ে গেলে এদের কেউ আর থামাতে পারবে না। আর তাছাড়া তোমরা আমার অতিথি, আমার কর্তব্য তোমাদের নিরাপদে রাখা। ভয় নেই, যেখানে লুকিয়ে রাখব কেউ খুঁজতে আসবে না।
-কিন্তু আমরা বেরোব কখন?
অভির প্রশ্ন। অসম্ভব অধৈর্য ছেলেটা। এক দাবড়ানি দিতে যাব এমন সময় অরিজিত বলে উঠল
– আমরা আন্দাজ বারোটা নাগাদ বেরোব। আমার আন্দাজ ওদের কাজ কারবার শুরু হয় রাত একটা নাগাদ।
-কি করে জানলে?
-আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বহুবার দেখেছি।
– দেখতে পায়নি ওরা?
-উঁহু। কিন্তু আর কথা নয়, দাঁড়াও তোমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করি।
আমাতে আর অভিতে একবার চোখে চোখে ইশারা হল শুধু। দিয়ে দু’জনেই সম্মতি জানালাম।
বাইরে উঁকি মেরে দেখি, উনুনের গনগনে আঁচে টগবগ করে হাঁড়িতে সেদ্ধ হচ্ছে চাল, ডিম আর আলু। তাপের লোভে ছাগলটাও অরিজিতের পাশে এসে বসেছে। পাশেই একটা ক্যাঁচ করে আওয়াজে চমকে দেখি, অভি বিছানায় লম্বা।
-কিরে?
-আরে শুয়ে যা না। কতক্ষণ রাত জাগতে হবে কোন ঠিক তো নেই।
কি আর করা। ভুল কিছু বলেনি। অগত্যা আমিও লম্বা হয়ে পড়লাম ওর পাশে।
আন্দাজ সাড়ে দশটা নাগাদ অরিজিতের ডাকে চটক ভাঙল। সারাদিনের ধকলের পর বোধহয় এমনিই চোখটা লেগে এসেছিল। বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি, গরমাগরম ফ্যানভাত, ঘি,আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ, আর কাঁচালঙ্কার আহার তৈরি। মনে মনে তারিফ না করে পারলাম না। খেয়েদেয়ে অরিজিত বলল
-আমি তোমাদের যা যা লাগবে নিয়ে আসছি, তোমরা ঘরে গিয়ে বসে থাকো। খবরদার, যেই ডাকুক, যা বলেই ডাকুক, সাড়া দেবে না। মনে করবে তোমরা মরে গিয়েছ।
এই বলে হারিকেনটার আলো একেবারে নিস্তেজ করে দিল।
-কিন্তু তুমি যাচ্ছ কোথায়?
অর্থপূর্ণ একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ও।
আমি আর অভি একবার চোখ চাওয়াচাওয়ি করলাম শুধু।

রাত সাড়ে বারোটা বাজছে এখন। আমি আর অভি দুটো মগডালে চড়ে বসে আছি। হিমেল রাতে একে তো হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া কুলপি বানিয়ে দিচ্ছে, উপরন্তু গাছের ডালপালা আবার শিশিরে ভিজে একসা। ভয় হচ্ছিল শেষটায় নিউমোনিয়া না হয়ে যায়। গাছের উলটোদিকে ধু ধু করছে ফাঁকা শ্মশান। অরিজিত আমাদের বসিয়ে দিয়ে কোথায় গেল কে জানে। আত্মরক্ষার জন্যে দুজনকে দুটো ছুরি দিয়েছে ও। হাজার হোক পাড়াগাঁ, মুন্ডুকাটা তান্ত্রিক না হোক সাপ বিছে বেরোতে কতক্ষণ! আর অরিজিত নিজের অস্ত্র যখন বের করেছিল, দেখে আমাদের দুজনেরই চোখ কপালে। অবিশ্যি পাড়াগাঁয়ে মানুষের কাছে .৩৮ ক্যালিবারের জিনিস দেখলে চমকে যাওয়ারই কথা।
-এটা কোথাথেকে পেলে?
আবার সেই অর্থপূর্ণ হাসি।
প্রায় তিনটে অবধি বসে বসে বিরক্ত হয়ে উঠেছি এমন সময় পিস্তলের আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। নিশ্চয়ই কোন কেলেঙ্কারি হয়েছে, নয়তো খামোকা গুলি ছুঁড়তে যাবে কেন ছেলেটা?
ঝুপঝাপ করে লাফিয়ে নেমে একবার চোখে চোখে ইশারা হল শুধু। আন্দাজ লাগিয়ে ছুটতে শুরু করলাম শব্দটার দিকে। খানিকদূর গেছি এমন সময় অভি আমার হাত ধরে একটানে রাস্তার পাশের ঝোপে সেঁধোল। অবাক হয়ে জানতে চাইতে যাব কি হল এমন সময় শুনি একজোড়া পায়ের আওয়াজ এগিয়ে  আসছে। হঠাৎ দেখি অরিজিত এসে আমাদের ঝোপটার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে দেখেই আমরা ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু  হালকা জ্যোৎস্নায় যা দেখলাম তা বোধহয় জীবনভর মনে থাকবে।
পুরো মুখটাই প্রায় রক্তমাখা, রক্তের স্রোত  কপাল থেকে গাল বেয়ে চিবুক অবধি নেমে এসেছে। বীভৎস রকম চোট খেয়েছে ছেলেটা।
-একি তোমার এই দশা কি করে হল?
শিউরে উঠে বললাম আমি। বাস্তবিকই, যেভাবে চোট খেয়েছে শিউরে ওঠারই কথা। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
– পড়ে গিয়েছিলাম। এটা নাও।
বলে ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট দিল হাতে।
-এটা কি?
-যা ওরা পাচার করে তার নমুনা। এর ভেতরে একটা চিঠিও আছে। তোমরা আর দেরি না করে এক্ষুণি বাসস্ট্যান্ডে চলে যাও। পৌনে চারটের সময় ফার্স্ট বাস। এর পরের স্ট্যান্ডে নামবে, সেখানে পুলিশ স্টেশন আছে। খবর দিয়ে ওদের ডাক্তারকেও নিয়ে এস। আমি ওদের দলের একজনকে ঘায়েল করেছি, বাকিগুলো পালিয়েছে। তোমরা আর দেরি কোর না, জলদি যাও। বাস আসতে বেশি দেরি নেই।
-কিন্তু তোমার তো খুব খারাপ অবস্থা? আগে তোমার ফার্স্ট-এড দরকার, তুমি..
-আমি ঠিক আছি। একটু আধটু রক্তপাতে কিছু হয় না আমার। আমি ঘাঁটি আগলে রাখছি, তোমরা দেরি না করে দৌড়োও।
বলতে বলতেই তড়বড় করে ছুটতে ছুটতে যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল ওদিকেই ফেরত চলে গেল।
পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখি সাড়ে তিনটে বাজছে। আর আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে স্ট্যান্ডে পৌঁছতেও কম সে কম কুড়ি মিনিট লাগবে। অতএব আর দেরি না করে পড়িমড়ি করে ছুটতে শুরু করলাম দুজনে। একটা জিনিস দেখে আশ্চর্য লাগল, গুলির আওয়াজেও পল্লীর কোথাও চাঞ্চল্য নেই। অথচ নিস্তব্ধ রাত, যে কোন আওয়াজই যথেষ্ট জোরে শুনতে পাওয়া যাবে।বুঝলাম, আতঙ্কের সীমা এদের এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এখন পড়শিদের জীবন বিপণ্ণ হলেও সাহায্য করতে বেরোয় না কেউ। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! আমাদের ভাগ্য ভাল, স্ট্যান্ডে পৌঁছতেই দেখি দূর থেকে বাসের হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। কোনওক্রমে থানায় পৌঁছে খবরটা দিলাম। যে অফিসার ডিউটিতে ছিলেন তিনি লোক ভাল, মন দিয়ে আমাদের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ডাক্তারকে আর কয়েকজন কনস্টেবলকে নিয়ে আমাদের সাথে রওনা দিলেন কুস্থলের উদ্দেশ্যে। গন্তব্যে পৌঁছে যা দৃশ্য চোখে পড়ল তা যেমনি বীভৎস তেমনি করুণ। স্ট্যান্ডের ঠিক মুখে অরিজিতের মৃতদেহটা পড়ে আছে, আর ওর সামনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে দোকানের মালিকটা। অরিজিতের কপালের ঠিক পাশেই একটা ফুটো, চাপ চাপ রক্ত মাটির ধুলোকে আরও রাঙিয়ে তুলেছে। ওর হাতে তখনও ধরা কালকের সেই পিস্তলটা।পুলিশের ডাক্তার গম্ভীরমুখে বডি দেখে রায় দিলেন,
– রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
অফিসার যথারীতি তন্নতন্ন করে তল্লাশি শুরু করে দিলেন। তার মাঝেও আমাদের জন্যে গরম চায়ের ব্যবস্থা করতে ভোলেননি। রীতিমতন কর্তব্যপরায়ণ বলতে হবে। আমরা চায়ের ভাঁড় প্রায় খালি করে এনেছি এমন সময় উনি এলেন আমাদের কাছে।
-তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ এত ঝুঁকি নেওয়ার জন্য। অলসো, তোমাদের মৃত বন্ধুটির সাহসেরও জবাব নেই। ওই চিঠিতে আঙ্গুলের ছাপ আর স্যাম্পেল অ্যানালাইজ করে এদের দলটাকে ধরা খুব শক্ত হবে না। তোমরা এখন কি করবে?
-ফিরে যাব।
বললাম আমি।
-বেশ বেশ। তবে যাওয়ার আগে একটা স্টেটমেন্ট লিখে দিয়ে যাও।
স্টেটমেন্ট-টেটমেন্ট লিখিয়ে নিয়ে আমাদের বাসে চাপিয়ে অফিসার বিদায় নিলেন। বাস চলতে শুরু করলে অভির দিকে তাকিয়ে দেখি থম মেরে বসে আছে।
স্বাভাবিক। কয়েকঘন্টার আলাপে যে প্রায় ভাইয়ের মতন হয়ে উঠেছিল, সে হঠাৎ করে খুন হলে শক তো লাগবেই। ওর মনটাকে হালকা করার জন্যে আমিই কথা শুরু করলাম।
-অরিজিতের অন্তত একটা স্মৃতি আমাদের কাছে রইল। ওই ছুরিদুটো।
আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। জানতে চাইতে যাব কি হল এমন সময় বলল,
-ও দুটো থেকে তিনটের মধ্যে মারা গেছে বলল না ডাক্তারটা?
-হ্যাঁ তো?
-সাড়ে তিনটের সময় আমাদের প্যাকেটটা এনে দিল কে?

6 thoughts on “অরিদমন

  1. গল্পটা পড়ে দারুন লাগলো। পাচার চক্র নিয়ে গল্প হলেও শেষে একটা অন্যরকম অপ্রত্যাশিত thrill পেলাম। মরে যাওয়ার পর ওদের সাথে কে দেখা করলো সেইটা। সবকিছুর সুন্দর বর্ণনা পড়ে মনের মধ্যে ছবি তৈরী হয়ে যাচ্ছিল খুব সুন্দর করে। শুধু গল্পের শুরু টা একটু কেমন লাগছিলো।

    Like

    1. জানি ভায়া। আসলে নতুন নতুন গপ্পো লেকার চেষ্টা কচ্চি কিনা, তাই এইরকম বাজে শুরু হয়েচে। নিজগুনে মাজ্জনা করে দেবেন পিলিজ।
      পুঃ: সাফাই গেয়ে ফেল্লুম না কি?

      Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান